২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

যে ‘উলঙ্গ’ যোদ্ধারা ব্রিটিশদের ভারত দখলে সহায়তা করেছিল

একজন নাগা সন্ন্যাসী ও তার শিষ্য। - ছবি : সংগৃহীত

তিনি ছিলেন শত্রুপক্ষের মনে ভয়-ধরানো এক যোদ্ধা-নেতা। তার নিজস্ব সেনাবাহিনীতে ছিল উলঙ্গ ও জটাধারী ঘোড়সওয়ার ও পদাতিক যোদ্ধাদের দল। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা কামানের মতো অস্ত্রও ব্যবহার করত।

কিন্তু অনুপগিরি গোঁসাই শুধু সৈনিক ছিলেন না, ছিলেন একজন সন্ন্যাসীও। তিনি ছিলেন হিন্দু দেবতা শিবের ভক্ত একজন নাগা বা নগ্ন সাধু, যাদের ভারতে খুবই সম্মানের চোখে দেখা হতো।

তারা একটি প্রধান হিন্দু ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য। যারা উলঙ্গ থাকেন, গায়ে মাখানো থাকে ছাই, আর মাথায় জটা।

ভারতের কুম্ভ মেলা, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। তাতে তাদের প্রায়ই দেখা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটের ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটির একজন ইতিহাসবিদ উইলিয়াম আর পিঞ্চ তার লেখা ‘ওয়ারিয়র অ্যাসেটিক অ্যান্ড ইন্ডিয়ান এমপায়ার্স’ বইয়ে লিখেছেন, গোঁসাই ছিলেন এমনই একজন যোদ্ধা সাধু।

নাগারা ‘ভয়ঙ্কর এবং উচ্ছৃঙ্খল’ এমন একটা ধারণা থাকলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই নাগারা ‘ভালো ভালো অস্ত্রে সজ্জিত এবং সুশৃঙ্খল’ ছিলেন।

ইলিয়াম আর পিঞ্চ বলেন, অশ্বারোহী এবং পদাতিক দু’ধরনেরই সেনা হিসেবেও তারা ছিলেন অত্যন্ত উন্নত মানের।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একজন নাগা সৈনিকের একটি পোর্ট্রেট আঁকিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মকর্তা জেমস স্কিনার।

ওই ছবিতে দেখা যায়, খালি পায়ে একজন নগ্ন সাধু, তার গায়ে ঝোলানো একটি চামড়ার বেল্ট, সাথে লাগানো বাঁকা তলোয়ার, আর কিছু কয়েকটি থলিতে ভরা বারুদ, গুলি এবং চকমকি পাথর।

তার ঘন ও জটপাকানো চুল মাথায় এমনভাবে প্যাঁচানো যে মনে হয় যেন তিনি একটা শিরস্ত্রাণ পরে আছেন।

তার বাম হাতে লম্বা নলওয়ালা ওই যুগের বন্দুক, যার নাম ছিল মাস্কেট। কপালে কমলা রঙের তিলক আঁকা।

পিঞ্চ লেখেন, ওই যুগে নাগাদের সুনাম ছিল আচমকা আক্রমণকারী সেনাদল হিসেবে, তাছাড়া হাতাহাতি যুদ্ধেও তাদের পারঙ্গমতা ছিল। অনুপগিরি গোঁসাইয়ের নেতৃত্বে তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ পদাতিক বাহিনী গড়ে ওঠে, যারা ওই সময়ের যেকোনো সেরা সৈন্যদলের সাথেও পাল্লা দিতে পারত।

অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে অনুপগিরি ও তার ভাই উমরাওগিরি ২০ হাজার লোকের বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। উনবিংশ শতাব্দীতে এসে কামান ও রকেটধারী সন্ন্যাসী সৈন্যদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়।

লেখক ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল অনুপগিরিকে বর্ণনা করেছেন, একজন ভীতিউদ্রেককারী নাগা সেনানায়ক হিসেবে। যাকে হিম্মত বাহাদুর বা সাহসী বীর হিসেবে মোগল খেতার দেয়া হয়েছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং কিভাবে তারা ভারতে আধিপত্য কায়েম করল তা নিয়ে ‘দি অ্যানার্কি’ নামে একটি বই লিখেছেন ইউলিয়াম ডালরিম্পল।

ওই বইতে তিনি লিখেছেন, মির্জা নাজাফ খান নামে একজন মোগল সেনানায়কের বাহিনীর কথা। ওই বাহিনীতেই যোগ দিয়েছিলেন ভিন্ন ধরনের একদল সৈন্য- অনুপগিরি গোঁসাইয়ের জটাধারী নাগা। যাতে ছিল ছয় হাজার নগ্ন সাধু এবং ৪০টি কামান।

অনুপগিরির বাহিনীর ব্যাপারে উল্লেখ করা হচ্ছে। তাতে ছিল ১০ হাজার গোঁসাইয়ের একটি সেনাদল (অশ্বারোহী ও পদাতিক), পাঁচটি কামান, রসদপত্রে ভর্তি অসংখ্য বলদে-টানা গাড়ি, তাঁবু এবং নগদ ১২ লাখ রুপি। ২০১৯-এর মুদ্রামানে এর পরিমাণ হবে ১৬ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ডের সমান।

অনুপগিরি ছিলেন একজন রহস্যময় ব্যক্তি, যাকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে সফলতম সামরিক উদ্যোক্তা বা ভাড়াটে বাহিনী বলা যেতে পারে।

কথাটা ভুল নয়। কারণ ওই যুগে রাজারা যে সমস্ত ব্যক্তিগত বাহিনী নিয়োগ করতেন, তার সবই ছিল ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে গঠিত।

ওই সময় বেনারস (এখনকার বারাণসী) শহরের বিচারক টমাস ব্রুক লিখেছেন, অনুপগিরির সম্পর্কে একজন সমসাময়িক ভারতীয় বলেছিলেন যে তিনি ছিলেন এমন একজন লোক, যিনি দুই নৌকায় পা রেখে নদী পার হচ্ছিলেন- যাতে কোনো একটি ডুবে গেলে তিনি আরেকটিতে চলে যেতে পারেন।

এতে তাই অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে সর্বত্রই এই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের যোদ্ধার উল্লেখ পাওয়া যায়।

পিঞ্চ বলেন, অনুপগিরিকে সর্বত্র দেখা যেত। কারণ তিনি ছিলেন এমন একজন লোক যাকে সবারই দরকার হতো। আবার তাকে যে দরকার হচ্ছে তার জন্য অনেকে ‌আবার তাকে পছন্দও করত না। যাদের ভাড়াটে সৈনিক দরকার তাদের কাছে তিনি ছিলেন একজন প্রয়োজনীয় লোক। আবার কোনো গোপন খবর বের করা, দু’পক্ষের মধ্যে আপসরফা করা বা কোনো একটা নোংরা কাজ কাউকে টের পেতে না দিয়ে করিয়ে নেয়া- এগুলোর জন্যও লোকে তার শরণাপন্ন হতো।

নানা পক্ষের হয়ে লড়েছেন অনুপগিরি
অনুপগিরি নানা পক্ষের হয়ে লড়াই করেছেন। ১৭৬১ সালের পানিপথের যুদ্ধে তিনি মোগল সম্রাট ও আফগানদের হয়ে মারাঠাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।

তিন বছর পর তিনি মোগল বাহিনীর হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন বক্সারের লড়াইয়ে। আবার দিল্লিতে পারস্যের নাজাফ খানের উত্থানেও অনুপগিরি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলেন।

এরও পরে তিনি যোগ দেন ব্রিটিশদের পক্ষে এবং তাদের হয়ে ১৮০৩ সালে মারাঠাদের পরাজিত করার যুদ্ধে ভুমিকা রাখেন।

পিঞ্চ লেখেন, ব্রিটিশদের দিল্লি দখলের যুদ্ধেও তিনি সহায়তা করেছিলেন। এটা ছিল ওই ঘটনা যার ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষিণ এশিয়ায় তথা বিশ্বে সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে ওঠে।

পিঞ্চের কথায়, অষ্টাদশ শতকে ভারতে মোগল ও মারাঠা শক্তির পতন এবং ব্রিটিশ শক্তির উত্থানের ঘটনাগুলোকে যতই পরীক্ষা করে দেখা যায়, ততই এর পশ্চাতে অনুপগিরি গোঁসাইয়ের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অনুপগিরির জন্ম ১৭৩৪ সালে উত্তর ভারতের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বুন্দেলখণ্ডে।

তার বাবার মৃত্যুর পর বিধবা মা দারিদ্র্যের কারণে অনুপগিরি ও তার বড় ভাইকে একজন যোদ্ধা নেতার হাতে তুলে দেন।

এমন গল্পও আছে যে তিনি মাটির তৈরি সৈন্যদের সাথে খেলে শৈশব কাটিয়েছেন, তবে এগুলো হয়ত নিতান্তই গালগল্প।

লোকের মুখে মুখে শোনা গল্পে আভাস পাওয়া যায় যে ১৬০০ শতকে মুসলিমদের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য অনুপগিরির মতো লোকদের অস্ত্রধারী হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।

তবে পিঞ্চ এমন তথ্য পেয়েছেন যে অনুপগিরি মোগল সম্রাট শাহ আলম এবং অন্য মুসলিম নিয়োগদাতার বাহিনীতে কাজ করেছেন। এমনকি আফগান রাজা আহমদ শাহ আবদালির পক্ষ নিয়ে তিনি ১৭৬১ সালে যুদ্ধ করেছেন মারাঠাদের বিরুদ্ধে।

তার জীবন নিয়ে যেসব কবিতা রচিত হয়েছে তাতে তার সঙ্গীদের মধ্যে মুসলিমরা ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।

পিঞ্চ লেখেন, অনুপগিরির প্রতিভা ছিল এখানেই যে ক্ষমতার ক্ষেত্রে তার অপরিহার্যতা তিনি তুলে ধরতে পারতেন। তার জন্ম উচ্চ শ্রেণিতে হয়নি এবং তিনি জানতেন যে কখন লড়াই করতে হবে আর কখন পালাতে হবে। তিনি জানতেন কিভাবে শত্রু ও মিত্র উভয় পক্ষকে বোঝাতে হয় যে তার হারাবার কিছুই নেই। সেটা ছিল এমন এক সময় ও স্থান যখন একজন সশস্ত্র সাধুকে দেখা হতো এমন একজন লোক হিসেবে যে মৃত্যুকে জয় করেছে।

ডালরিম্পল তার লেখায় বক্সারের যুদ্ধের নাটকীয় বর্ণনা দিয়ে লেখেন, যে যুদ্ধের ফলে বাংলা ও বিহারে ব্রিটিশ ক্ষমতা নিশ্চিত হয়েছিল।

ওই যুদ্ধে অনুপগিরি তার উরুতে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন। আহত অবস্থায় তিনি মোগল সম্রাট সুজা-উদ-দৌলাকে বোঝান যেন তিনি রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান।

তিনি বলেন, ‘অনর্থক মারা যাওয়ার মুহূর্ত এটা নয়। আমরা অন্য আরেকদিন সহজেই জিততে পারব, প্রতিশোধ নিতে পারব।’

তারা তখন নৌকা সাজিয়ে তৈরি একটি সেতু দিয়ে নদী পার হয়ে পালালেন। অনুপগিরি আদেশ দিলেন, সেতুটি যেন এর পরপরই ধ্বংস করে ফেলা হয়, যাতে আরেক দিন যুদ্ধ করার জন্য বেঁচে থাকা যায়।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
ভান্ডারিয়ায় জামায়াতের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত ট্রাকচাপায় ফায়ার ফাইটার নিহতের ঘটনায় মামলা ইরানের কাছে ৩০০ বিলিয়ন ক্ষতিপূরণ দাবি করল সিরিয়ার নতুন সরকার সচিবালয়ে আগুন : ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ৩ মন্ত্রণালয়ের কমিটি নিহত ফায়ার ফাইটার নয়নের পরিবারে শোকের মাতম এক কার্গো এলএনজি ও এক লাখ ৩০ হাজার টন সার কিনবে সরকার জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক বলরাম পোদ্দার কারাগারে ছুরিকাঘাতে গাজীপুর মহানগর জামায়াত সেক্রেটারি আহত কুলাউড়ায় নিষিদ্ধ পলিথিন রাখায় ২ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের সময় বাড়ল দেশে পৌঁছেই যা বললেন মিজানুর রহমান আজহারী

সকল